তারা বলেন আর কাঁদেন, আমি লিখি আর কাঁদি
জাকিয়া আহমেদ :
ঢাকা: ১৯ মার্চ-দুপুর ১টা। আর্মি স্টেডিয়ামের ভেতরে সাজানো হচ্ছে একটি মঞ্চ। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতায় কয়েকজন দ্রুতগতিতে মঞ্চের কাজ করে চলেছেন। মাঠের ভেতরে তখনও মঞ্চের জন্য আনা কয়েকটি বাঁশ পড়ে আছে, সাদা কাপড়ে মঞ্চের চারদিক ঢেকে দেওয়া হচ্ছে, ভেতরে বিছানো লাল কাপড়।
স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে মঞ্চে আসার পথেও বিছানো হয়েছে লালগালিচা। কিছু সময় পরই মঞ্চে আনা হলো গ্লাডিওলাস ফুলের তিনটি তোড়া। একে একে সেই মঞ্চ ভরে উঠল সাদা-শুভ্র ফুলে ফুলে।
বিকেল ৫টার কিছু পরে মঞ্চ আনা হলো ২৩টি কফিন। পাঁচ সারিতে রাখা ২৩টি কফিন। প্রতিটি সারিতে চারটি আর একটি সারিতে তিনটি।
কফিনগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে কলিমা লেখা গিলাফে। আর পাশেই গ্যালারিতে বসে কফিনে ঘুমিয়ে থাকা নিথর দেহের মানুষগুলোর স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে বাতাস যেন জমে গেছে আর্মি স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গণমাধ্যম কর্মীরাও যেন কষ্টে পাহাড়ের মতো ভারি হয়ে গেছেন। তাদের পেশাটা কঠিন-কিন্তু তারাও তো রক্ত মাংসের মানুষ। বুকের ভেতরে তাদেরও পোড়ে, চোখের ভেতরে জ্বালা করে, গলার ভেতরে কিছু একটা আটকে থেকে রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ। দায়িত্ব পালন করেছেন ঠিকই, কিন্তু দায়িত্বের খোলস ছেড়ে বারবার বেরিয়ে এসেছে ভেতরের মানুষ। যে কেবল সাংবাদিক নন…।
আর তাই চির বিদায় নেওয়া মানুষগুলোর স্বজন যখন কথা বলছিলেন, আর্তনাদ করছিলেন তখন নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই।
দুপুর আড়াইটার একটু পরে স্বজনদের মধ্যে প্রথম প্রবেশ করেন কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের বাবা-মা। সঙ্গে ছিলেন আরও তিন আত্মীয়। তখনই বদলাতে শুরু করে স্টেডিয়ামের আবহ। তাদের কান্না, বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বুক চাপড়ানো আর্তনাদ, নুরুজ্জামান বাবুর ১২ বছরের ছেলে হামিম জামান নিশাতের ফ্যাকাসে চোখ, মতিউর রহমানের ভাই মোকসুদুর রহমান ছিলেন ভাইয়ের ছবি হাতে কিন্তু মূক মতিউরের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা নোনাজল, কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মোহাম্মদ সাফের স্ত্রীর সমস্ত কথা যেনো ফুরিয়ে গেছে, নিহত কেবিন ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলার আড়াই বছরের মেয়ে হিয়া কিছু না বুঝেই বাবার কোলে ঘুরছে- সবই যেন বড় কঠিন হয়ে ধরা দিয়েছে আজ আমাদের কাছে। তাদের আর্তনাদ বাড়ছিল চৈত্রের ঝলসানো রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
গত ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলা ড্যাশ ৮- কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি। পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ, কেবিন ক্রু খাজা হোসেন সাফে, শারমিন আক্তার নাবিলা, সাংবাদিক ফয়সাল আহমেদ, রফিক জামান, সানজিদ হক বিপাশা, অনিরুদ্ধ জামান, বিলকিস আরা, আখতারা বেগম, বেগম বিলকিস বানু, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, রকিবুল হাসান, হাসান ইমাম, মিনহাজ বিন নাসির, আঁখি মনি, ফারুক হোসেন প্রিয়ক এবং তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী তামাররা, মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহিরা তানভিন শশী রেজা, বেগম উম্মে সালমা এবং মো. নুরুজ্জামান নামের মানুষগুলো এখন কেবলই ছবি।
কেউ গিয়েছিলেন বেড়াতে, কেউ অফিসের কাজে আবার কেউ হানিমুনে। অথচ ফিরে এলেন কফিন বন্দি হয়ে। তাদের নামাজে জানাজা হয় আর্মি স্টেডিয়ামে। সেখানে এক গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে প্রতিটি ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় আমাদের। অতীতেও অনেক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হতে হয়ে। ধারণা ছিল ঠিক সামলে নেব। কিন্তু স্বজনদের আহাজারি যে তীর হয়ে বুকে বিধবে- সেটা আগে বুঝিনি। এর আগেও রানা প্লাজায় টানা তিনদিন সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়ে, এই স্টেডিয়ামেই হলি আর্টিজানে নিহত দেশি-বিদেশিদের সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন- সে সময়ও থাকতে হয়েছে। হেলথ বিটে কাজ করায় প্রায় প্রতিদিনই যেতে হয় হাসপাতালে। কিন্তু ২৩ বাংলাদেশির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাদের মরদেহ হস্তান্তরের প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে কাঁদিয়েছে।
দায়িত্ব পালনের জন্যই প্রতিটি স্বজনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, কথা বলেছি, কিন্তু পৃথুলার মা যখন বলছিলেন- ‘এমন এক সোমবারেই আমার বাচ্চাটা গিয়েছে, ফ্লাইটে থাকার সময়টুকু ছাড়া প্রতি আধঘণ্টা পরপর সে আমার সঙ্গে কথা বলত, কিন্তু আজ কতদিন হয়ে গেল, আমার মেয়েটা-আমার বাবুটা আমার সঙ্গে কথা বলে না, ফ্লাইট থেকে ফিরেই ফোন করত, হাসিমুখে বাসায় ঢুকত কিন্তু আজ আমার পৃথু নিথর হয়ে কফিনে শুয়ে আছে-আমি কী করে এই পৃথিবীতে বাঁচব, কী করে ওই ঘরে আমি বেঁচে থাকব’। তখন আমাকে বাধ্য হয়েই তার সামনে থেকে দূরে সরে আসতে হয়েছে- পৃথুলার মায়ের কান্না সহ্য করার মতো শক্তি আমার ছিল না। আমি আমার পেশাদারিত্ব ধরে রাখতে পারিনি।
কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মোহাম্মদ সাফের বাবা যখন গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্নে জবাবে বলছিলেন, নিজের সন্তান, আমার বাচ্চা, তাকে কবর দেব, দাফন করব, এ শব্দটা এ মুখে উচ্চারণও করতে চাই না-তখন সেখান থেকে সরে আসা ছাড়া আমার আর কোনও পথ ছিল না, এমনকি আমার অন্য সহকর্মীরাও তাদের হাতে থাকা মাইক্রোফোন সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ –পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি, কী করে বইবেন খাজা গোলাম মহীউদ্দীন সাইফুল্লাহ?
স্বজনরা এর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। কিন্তু মৃত্যু তাদের এক করেছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারির একপাশে লেখা ছিল– বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজন। সেখানে কিছু পর পর কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করে, যখন মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় কফিন মাঠে প্রবেশ করবে। সবার দৃষ্টি তখন স্টেডিয়ামের ৪ নম্বর গেটে। বিকেল পাঁচটার পরে মাঠে সেনা সদস্যদের কাঁধে কফিন আসে। রাখা হয় সেই সাদা ফুলে সাজানো মঞ্চে।
নাম ঘোষণার পর একে একে স্বজনরা যাচ্ছেন আর কফিনের জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। নুরুজ্জামান বাবুর সেই ১২ বছরের ছেলে নিশাত, বাবার ছবি হাতে দাঁড়িয়ে। বাবার কফিনের সামনে। ছেলে কাঁদে- কাঁদি আমরা। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে? সবার প্রিয়জনই যে ওই কফিনে বন্দি!
আমি স্বজনদের সঙ্গে কথা বলি- তারা কাঁদেন, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি শক্ত থাকতে- পারিনি, আমার হাতে নোটবুক- ভিজে যায়। স্বজনরা কথা বলেন আর কাঁদেন, আমি লিখি আর কাঁদি।
কফিনে আঁটা ‘কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মোহাম্মদ সাফে’ স্টিকারে বৃদ্ধ মা হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন- আমি আর বৈশাখী টিভির সিনিয়র রিপোর্টার রীতা নাহার দু’জন-দু’জনের হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি, মিনহাজ বিন নাসিরের ভাই মেরাজ যখন কফিন ধরে কাঁদেন, গণমাধ্যমকর্মী সাদ্দিফ অভির চোখ ছলছল করে ওঠে, ছবি তুলতে গিয়ে লেন্স থেকে চোখ নামিয়ে নেন আলোকচিত্রী সুদীপ্ত সালাম।
এর আগে যখন স্বজনদের নাম ডাকা হচ্ছিল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই আমি সাদিয়া রহমানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সাদিয়া নিজেও একজন কেবিন ক্রু, একসঙ্গে লেখা-পড়া করেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে, ভালবেসে বিয়ে করেছেন ১ বছর ২ মাস ১১ দিন আগে। আমি দেখতে চাই, ভালবাসার সেই মানুষটির নাম যখন বলা হবে- তখন তার কী প্রতিক্রিয়া হয়! আমার পেশা আমাকে এটাই শিখিয়েছে। ৫টা ২২ মিনিটে যখন সাফের নাম উচ্চারণ করা হয় তখন ডুঁকরে ওঠেন সাদিয়া, পাশে থাকা স্বজনের হাত জড়িয়ে শূন্যে তাকান…।
কিছুক্ষণ আগেই তিনি এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, সেদিন যাবার আগেও সাফে তাকে এসএমএস-এ লিখেছিলেন, ‘মিস ইউ।’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সাদিয়ার গলা ধরে আসে, কথা শেষ হয় না।
সাদিয়ার বলা ‘মিস ইউ’ শব্দটা কানে বাজছে। সাদিয়া হয়তো বারবার ফিরে যাবেন তার পুরনো ম্যাসেজ বক্সে, মনের ভুলে কিংবা অভ্যাসবশত। ইনবক্স চেক করবেন সাফের নতুন ম্যাসেজের আশায়।
এক সময় স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয় মরদেহ। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায় আর্মি স্টেডিয়াম। কাজ তো বাকি আমারও, অফিসে ফিরে আরও নিউজ করতে হবে। অফিসে ফেরার পুরো পথে কানে বাজতে থাকে ‘মিস ইউ।’
হঠাৎ বিভ্রম ভাঙে- মরদেহ হস্তান্তরের নিউজ দেওয়া হয়নি। আমি ভুলে গেছি। অফিসে ফিরে লিখতে বসে বারবার ঝাপসা হয়ে আসছিল লেখাগুলো। নিউজ এডিটর জান্নাতুল ফেরদৌসী আর সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আবু তালহা আমাকে নিয়ে অফিসের ছাদে যান একটু রিলিফের আশায়। ছাদে গিয়ে আমি স্টেডিয়ামের কথা বলি আর কাঁদি, আর কান্না যে সংক্রামক-তা কে না জানে!
যে কান্না আমি দেখে এলাম, সে কান্নার রঙ আমাকে ছুঁয়ে আছে। কী সাধ্য আমার সেখান থেকে বের হবো! বুকের ভেতরটা যে অচেনা মানুষগুলোর জন্য কাঁদছে। আন্ধকারের মতো বুক ভরে উঠছে স্বজনদের হাহাকারে।
লেখক: জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা
সূত্র-সাররাবাংলা.নেট