নিনাদের জন্য কষ্ট এবং ভালোবাসা
ছবিটা একবার দেখছি। বারবার দেখছি। একটু পর পরই দেখছি। দেখছি আর ভারাক্রান্ত হচ্ছি। চোখ ভিজে যাচ্ছে। ছবিটি নিনাদের। ওকে আমি আগে কখনো দেখিনি। ওর নামও শুনিনি। দেখা-শোনার কথাও নয়। ওর বাবা-মা আমার পরিচিত নন।
পরিচিত হলেই বা কি! আজকাল তো কত পরিচিত জনেরই সঙ্গেই দেখা হয় না। মানুষে মানুষে ভার্চুয়াল যোগাযোগ যত বাড়ছে, তত বিচ্ছিন্নতাও বাড়ছে। নিনাদের ছবিটি এখন আমার সামনে নানা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। সুদূরে প্রসারিত অত্যন্ত মায়াবী দুটি চোখ, ঈষৎ হাঁ করে থাকা মুখে বেরিয়ে আসা অসমান সাদা দুটি দাঁত কত জিজ্ঞাসাচিহৃ হয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করছে।
আট বছর বয়সের এই শিশুটিকে ঈদের আগের রাতে অর্থাৎ চানরাতে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ওকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবছি কিন্তু কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারছি না। মানুষ এতোটাই বর্বর হতে পারে? নিষ্ঠুর হতে পারে? কোন পাষন্ড হাত ওর শ্বাস রোধ করলো? তার বা তাদের একবারও বুক কাঁপলো না? হাত কাঁপলো না? তার বা তাদের শিশু সন্তান নেই? ভাই নেই? ভাগিনা নেই? শিশুর প্রতি ভালোবাসা নেই?
শিশুকে ভালোবাসে না -এমন নির্দয় মানুষ কি করে এই সুন্দর পৃথিবীতে খায়দায় ঘুরে বেড়ায় বেঁচে থাকে? আমি বুঝতে পারি না, আমার মাথা কাজ করে না।
আমি জানি না, নিনাদের মা-বাবা কি করে সহ্য করছেন শিশুপুত্র হারানোর এই ব্যথা? তাদের বুক ফাঁটা কান্না আমি শুনিনি। শুনতে চাই না। কিন্তু ওর মামা, সাংবাদিক এস এম মুন্নার হাহাকার, আর্তনাদ আমি শুনেছি, প্রতি মুহূর্তে শুনছি। মুন্না একসময় আমার সহকর্মী ছিল। মুন্নাকে, নিনাদের অন্য স্বজন-পরিজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই।
কি লিখবো নিনাদকে নিয়ে? কি লেখার আছে? প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই যে ফুল বোঁটা থেকে ছিঁড়ে ফেলা দেওয়া হলো সে ফুল নিয়ে বিলাপ করে কি লাভ তা-ও বুঝতে পারছি না। তবে আমরা যে আমাদের দেশটাকে নিষ্পাপ শিশুদের নিরাপদ বাসভূমি করতে পারছি না, সে বিষয়টি বুকে কাঁটা হয়ে বিঁধছে। প্রশ্ন হলো, নিনাদের ঘাতকদের কি গ্রেপ্তার করা হবে? তারা কি শাস্তি পাবে? সম্পত্তির লোভ এবং তা নিয়ে বিরোধই যদি নিনাদকে হত্যার প্রকৃত কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ঘাতকদের এমন শাস্তি দেওয়া উচিত যাতে সম্পত্তি ভোগ করার সাধ আর তাদের কোনোদিন পূর্ণ না হয়!
নিনাদের পুরো নাম সাফওয়ান-আল- নিনাদ। বাবার নাম স্বপন বেপারী। বনশ্রীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র। তিন বছর বয়সী তার একটি বোন আছে। রাজধানী ঢাকার খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া ভুঁইয়াপাড়ায় তাদের বসবাস। নিনাদের বাবার সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজনের জমিজমা নিয়ে বিরোধ আছে। মামলা-মোকদ্দমাও আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সম্পত্তিবিরোধের শিকার হতে হয়েছে নিনাদকে।
পরের দিন ঈদ। খুশির ঈদ। ঈদ উদযাপনের নানা পরিকল্পনা হয়তো নিনাদের ছিল। ঈদটা ঢাকায় পালন করে পরদিন তার দাদাবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল কুমিল্লায় । ঈদ উপলক্ষে কয়েকসেট নতুন পোশাক পেয়ে আনন্দেই ছিল নিনাদ। নতুন লাল জামা ও জুতা পরে সে চাঁদরাতে প্রতিবেশী অন্য শিশুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছিল। সময় গড়িয়ে যায়, রাত গভীর হয়, নিনাদ আর ঘরে ফেরে না। উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজন চারদিকে খোঁজ-খবর করেন। কিন্তু নিনাদকে আর পাওয়া যায় না। তার মামা মুন্না ভাগ্নের এই খবর জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। না, নিনাদ আর আসে না, তাকে কোথাও পাওয়া যায় না।
কি করে পাওয়া যাবে, কি করে ফিরবে এই শিশু! তাকে যে ততক্ষণে হরণ করা করা হয়েছে না-ফেরার দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। পরদিন বাসা থেকে অনতিদূরে এক ভ্যানগাড়িতে পাওয়া যায় তার লাশ।
নিনাদের বাবার সঙ্গে যাদের সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ তাদের নাম উল্লেখ করে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেছেন স্বপন বেপারী। এটাই স্বাভাবিক। এখন দেখার বিষয় পুলিশ ঘটনা তদন্তে সফল হয় কি না। একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, পুলিশ চাইলে পারে না এমন কিছু নেই। পুলিশ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করলে নিনাদের খুনিদের ধরতে পারবে বলে আমরাও বিশ্বাস করতে চাই।
নিনাদের বাবা দোষী হতে পারেন। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধে তার দায় থাকতে পারে, তার অন্য আত্মীয়দের দায় থাকতে পারে, কিন্তু নিনাদের তো তাতে কোনো ভূমিকা ছিল না, থাকতে পারে না। সে যে এক অবোধ শিশু! এই শিশুকে হত্যা করে যে বা যারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করলো তাদের যদি শাস্তির আওতায় আনা না যায় তাহলে মানুষ হিসেবে আমাদের লজ্জার শেষ থাকবে না। এর আগেও দেশে শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সব ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরা পড়েনি, শাস্তি পায়নি। এই শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারার কারণেই শিশুহত্যা বন্ধ হয় না, হচ্ছে না। মানুষের মধ্যে রেষারেষি থাকবে, বিরোধ-ঝগড়াঝাটিও থাকবে কিন্তু বড়োদের এসব অপরাধপ্রবণতার জন্য নিরপরাধ কোনো শিশুর জীবন যাতে বিপন্ন না হয় সেটা আমাদের নিশ্চিত করতেই হবে।
আমাদের বিবেক জাগ্রত হোক। নিনাদহত্যার প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে সোচ্চার হই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সূত্র: সারাবাংলা.নেট