আপনার গায়ে সাতক্ষীরার মাটির গন্ধ পাচ্ছি
॥ এম.কামরুজ্জামান ॥
সত্যিই আমি মুগ্ধ, অভিভূত। গত ১৭ জুলাই ২০১৮, গিয়েছিলাম রংপুরে একটি সেমিনারে যোগদিতে। সেখানে গিয়ে দেখা হলো সাতক্ষীরার দুই কৃতি সন্তানের সাথে। রংপুর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের এডিশনাল এস পি আবু বকর সিদ্দীক ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জনাব উমর ফারুকের সাথে। সহোদর উনারা। বয়সে আবু বকর সিদ্দীক বড় এবং উমর ফারুক ছোট। বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রিউলা ইউনিয়নের নাকতাড়া গ্রামে।
উনাদের দু’জনের বড় পরিচয় হলো- দু’জনই লেখক। বড় ভাই আবু বকর সিদ্দীক একজন লেখক, সাহিত্যিক, গবেষক। বিশেষ করে লালনকে নিয়ে তার গবেষনা রয়েছে। একাধিক বই লিখেছেন তিনি।
আর উমর ফারুক প্রথম আলো, সমকাল, খোলা কাগজের একজন নিয়মিত কলাম লেখক। তার লেখা বই রয়েছে একাধিক। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অসংগতির বিরুদ্ধে তার লেখার হাত অসাধারণ।
উনাদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। বিশেষ করে অধ্যাপক উমর ফারকের সাথে আমার প্রায় মোবাইলে কথা হয়। খুবই আন্তরিক মানুষ। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ তিনি। আর বড় ভাই আবু বকর সিদ্দীকের সাথে দুবছর আগে এক-দুইবার সেল ফোনে হয়তো কথা হয়েছে।
উনারা দু’জনই আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত “ ভয়েস অব সাতক্ষীরা ডটকম ” এর নিয়মিত পাঠক। বিশেষ করে জনাব উমর ফারুকের সাথে আমার বহু আগে থেকে সেল ফোনে কথা হয় সাতক্ষীরার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে । কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কোন দিন আমাদের সরাসরি দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি।
রংপুরে যাবার আগে যথারিতি ফোনে জনাব উরম ফারককে বললাম, মঙ্গলবার ভোরে ( ১৭ জুলাই ২০১৮ ) আমি রংপুরে পৌছাবো। আমার আসার কথা শুনে যেন পাগল হয়ে গেল। আমারও দেখাকরার আগ্রহটা কম নয়। সোমবার রাত ১০ টায় যখন যশোর থেকে ট্রেনে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক সেই সময় সেল ফোনটি বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই অপরপ্রাপ্ত থেকে পরিচয় দিলেন আমি উমর ফারুকের বড় ভাই। থাকি রংপুরে। দারুন আন্তরিকতার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ জানালেন। তখনও জানিনা উনি পুলিশ কর্মকর্তা। পরে উমর ফারুকের কাছে পরিচয় জেনেছি। আমি সাতক্ষীরার মানুষ, রংপুরে গিয়েছি জানতে পেরে তারা দুই ভাই যেন আত্মহারা। তাদের আন্তরিকতা দেখে দেখা করার আগ্রহটা আমারও বেড়ে গেল কয়েক গুন।
সেমিনার শেষ হলো বেলা ২ টার দিকে। সকাল থেকে একটু পর পর দুই ভাই-এর ফোন পাচ্ছি। সেমিনার কখন শেষ হবে , কখন আসবেন ইত্যাদি ইত্যাদি--।
যাই হোক, দুপুরে সেমিনার শেষ করে আমার সহকর্মী সুমন মুখার্জীর সাথে নিয়ে চলে গেলোম রংপুর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে বড় ভাই আবু বকর সিদ্দীকের সাথে দেখা করতে। দেখা মাত্রই যেভাবে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তা দেখে সত্যিই আমি অভিভূত, মুগ্ধ। রংপুরের সেই ঐতিহ্যবাহী হাড়িভাঙা আম, পেয়ারা, রংপুরের হাড়িভাঙা মিষ্টি আর চা’র কথা যেনো ভোলার নয়।
হাতে সময় খুবই কম। বিকাল সাড়ে ৫ টায় রংপুর থেকে সৈয়দপুর রেল স্টেশনের দিকে রওনা হওয়ার কথা। সন্ধ্যা ৭ টা ৫০ মিনিটে ফিরতি ট্রেন। অপর সহকর্মীরা সেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে। বিধায় সেমিনার স্থলে আবার ফিরতে হবে। কিন্তু বড় ভাই আবু বকর সিদ্দীকের সাথে কথা যেনো ফুরাচ্ছে না। কত কথা----। কথার ফাঁকে বললেন ‘আমি আপনার গায়ে সাতক্ষীরার মাটির গন্ধ পাচ্ছি’। শুনে সত্যি চোখে পানি এসেগেলো।
যাইহোক খুবই আনন্দঘন পরিবেশে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। এর পরে যেতে হবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। চলে আসার সময় বড় ভাই আবু বকর সিদ্দীকের লেখা “লালন মেলায় পাগলেরা”, “অন্ধগলির ব্যবচ্ছেদ” নামের পৃথক দু’টি বই আমাকে উপহার দিলেন। সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরীর জন্যও আরো এক সেট বই আমার হাতে তুলে দিলেন।
আমার সাথে রংপুরে গিয়ে ছিলেন সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনিসুর রহিম। সেমিনার শেষে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে উনি আমার সাথে আর বের হতে পারেননি। তাই বলে কি হবে, অধ্যাপক আনিসুর রহিমের জন্যও এক সেট বই আবু বকর সিদ্দীক পাঠিয়ে দিতে ভূল করলেন না।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল আমার। বড় ভাই আবু বকর সিদ্দীক গাড়ি দিয়ে পৌছে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে জনাব উপর ফারুক।একই ভাবে দেখামাত্রই পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলেন। মধুর আন্তরিকতা। যেনো বুকটা ছাড়তেই চাচ্ছে না। আপ্পায়নের পর ক্যাম্পাসটি ঘুরে ঘুরে দেখালেন তিনি। সহকর্মী অন্য শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিদায় বেলা একই ভাবে উমর ফারুকের লেখা “ব্যাজস্তুতি” আমকে উপহার দিলেন। তিনিও সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরীর জন্যও এক সেট বই আমার হাতে তুলে দিলেন।
সত্যিই জনাব আবু বকর সিদ্দীক ও জনাব উমর ফারুকের আন্তরিকতা, সাতক্ষীরার মানুষেরপ্রতি তাদের যে নাড়ির টান, মাটির টান তাদেখে আমি অভিভূত। দিনটি আমার কাছে স্বরণীয় হয়ে থাকবে।
অল্প কিছুক্ষণের আলাপচারিতায় দুই ভাই বার বার বলার চেষ্টা করছিলেন, বাবার অভাবের সংসারের সেই দারিদ্রতাকে জয় করে কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন তারা। জীবনযুদ্ধের সেই কাহিনী আমাকে শুনিয়ে নিজেরা যেন তৃপ্তি অনুভব করছিলেন। যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বীরল। আমরা প্রায় সবাই বলতে অভ্যস্ত যে, সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমাদের জম্ম। মানুষকে সেই গল্পই শুনাতে পারলে যেনো ভালো লাগে আমাদের। কিন্তু না, একটু ব্যতিক্রম মানুষ মনে হলো জনাব আবু বকর সিদ্দীক ও জনাব উমর ফারুকে।
শুনে খুশি হবেন, তারা ভাই-বোনেরা মিলে প্রতিবছর এলাকায় দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজেদেরকে এলাকায় বিভিন্ন সামজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে রাখেন।
আশা করছি সামাজিক, রাজনৈতিক ,অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অসংগতির বিরুদ্ধে তাদের যে লড়াই তা অব্যাহত থাকবে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন তাদের দুই ভাইকে নিয়ে এই লেখা। আমি তাদেরকেই বলছি, মাটির টান ও নাড়ির টানের এই গল্প থেকে আমরা যেন কিছু শিখতে পারি। দেশে ও প্রবাসে যারা আছেন, যাদের জম্ম এই সাতক্ষীরার মাটিতেই তাদেরকে স¤œান জানিয়ে বলছি, এই গল্প থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে, অনেক কিছু নেওয়ার রয়েছে। আমার পরিচিত অনেকে রয়েছেন যারা সাতক্ষীরায় জম্ম এই পরিচয় টুকু দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন ( সেকথা একদিন লিখবো )। অথচ তারা অনেক বড় মাপের মানুষ। তারা ইচ্ছে করলে সাতক্ষীরাকে পাল্টে দিতে পারেন বা পারতেন।
সাতক্ষীরা আজ অনেক কিছু থেকে পিছিয়ে। সাতক্ষীরার মাটির এই গন্ধ যদি জনাব আবু বকর সিদ্দীক ও জনাব উমর ফারুকের মতো আমাদেরকে কাছে টানে বা আকৃষ্ট করে তাহলে আমাদের গর্বের সাতক্ষীরা আর পিছিয়ে থাকবে না। আসুন সবাই মিলে এই সোনার বাংলাদেশ , সোনাভরা এই সাতক্ষীরার জন্য কিছু করি।
.................................................................................................
লেখক: সম্পাদক, ভয়েস অব সাতক্ষীরা ডটকম। ও
স্টাফ রিপোর্টার, এটিএন বাংলা / দৈনিক সমকাল, সাতক্ষীরা।