রিতা এবং একটি অলৌকিক কাহিনী
॥ মনিজা রহমান ॥
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কোন উপন্যাসে সম্ভবত প্রথম বাক্যটা পড়েছিলাম- ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’। সে অনেক কাল আগে। কৈশোর আর তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে। তবে জীবনের নানা মোড়ে মোড়ে এই উক্তির প্রমাণ পেয়েছি। যার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আমাদের রিতা। ‘এইচ বি রিতা’ লেখক নামে যিনি সমধিক পরিচিত।
কেউ ভাবেনি। রিতা নিজেও কি ভেবেছিল ? এমন একটি অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিবে তাঁর জীবন! জটিল একটি রোগে গত কয়েক মাস ধরে ভুগছিল ও। যে কারণে একটি বিশেষ ধরনের স্টেরোয়েড গ্রহণ করতে হচ্ছিল রিতাকে। যার প্রভাবে কয়েক মাস ধরে ওর সারা শরীর ফুলে যায়। এরই মধ্যে প্রিয় সাপ্তাহিক প্রথম আলো অফিসে নিয়মিত আসতো। প্রথম আলো যে কোন অনুষ্ঠানে শতভাগ নিজেকে উজাড় করে দিত। নিয়মিত লিখতো নানা বিষয় নিয়ে। এমনকি হাসপাতালের স্ট্রেচারে শুয়েও রিতা রিপোর্ট লিখেছে প্রথম আলোর জন্য।
রিতা কাজকে ভালোবাসতো। যে কোন দায়িত্ব দিলে জান-প্রাণ দিয়ে করতো। উত্তরের নকশার প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে সবাইকে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব মূলত রিতাই পালন করেছিল। দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের নিউইয়র্ক আগমন উপলক্ষে বন্ধু সমাবেশে সে ছিল কর্মতৎপর। অথচ শারীরিকভাবে তখনও সে পুরোপুরি ফিট নয়। কেউ বিপদে পড়লে সে কাতর হত। রাতে ঘুমাতে পারতো না। কেউ অসুস্থ হলে সে বাংলাদেশে হোক কিংবা নিউইয়র্কে, সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে তাকে সাহায্য করতো। হাসপাতালের যাবার মাত্র দুই দিন আগেও সে সাহিত্য একাডেমিতে গিয়েছিল। কারণ সেখানে সদ্য ডিপোর্টেশন হওয়া প্রিয় আহমেদ হোসেন বাবু ভাইকে নিয়ে আলোচনা হবে।
অথচ ডাক্তারের কঠিন নিষেধ ছিল প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাবার। কারণ ওর রোগের বৈশিষ্ট্যই ছিল শরীরের ‘ইমিউনিটি পাওয়ার’ কে কমিয়ে দেয়া। স্টেরোয়েড ওর জীবনীশক্তিকে কেড়ে নিচ্ছিল একটু একটু করে। অথচ খুব সুন্দর ও প্রাণবন্ত একটা মেয়ে ছিল ও।
আমি রিতাকে প্রথম দেখেছিলাম সম্ভবত ২০১৫-১৬ সালে পপি চৌধুরী সম্পাদিত ‘নারী’ পত্রিকার একটি অনুষ্ঠানে, জুইশ সেন্টারে। সেবার কথা না হলেও চেহারাটা মনে ছিল। যে কারনে কিছুদিন পরে রিজউডে আমার ছোট ছেলে সৃজনের স্কুল ‘পিও সেভেন্টি ফাইভ’ এ যখন দেখলাম, কথা বলতে আগ্রহী হলাম। আমার স্বামী তো প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না মেয়েটা বাঙালী। এত স্মার্ট, ঝকঝকে একজন তরুণী! ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সৃজনের স্কুলে দোভাষীর কাজ করে। এরপর এই স্কুলেই ইএসএল টিচার হিসেবে যোগ দেয়। যেটা মোটেও সহজ চাকরী নয়। নিউইয়র্কের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়েছে রিতাকে এই চাকরীর উপযুক্ত হবার জন্য।
বইমেলায় রিতা ও মনিজা রহমান
উজ্জ্বল ও মেধাবী সেই মেয়েটির একটি দুঃসংবাদ শুনলাম ফোর্থ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের দিনে। আতশবাজির আলোয় ঝলমলে এস্টোরিয়া পার্ক। তারমধ্যে সাপ্তাহিক প্রথম আলো সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরীর একটি কথা ফিকে ও ম্লান করে দিল চারপাশ। তিনি ব্যাথিত কণ্ঠে বললেন, ‘রিতার লিভার কাজ করছে না। ও সবার কাছ থেকে বিদায় চেয়েছে।’ কথাটা নিতে পারছিলাম না। কত সম্ভাবনাময় একটি মেয়ে ও। কত কিছু আছে ওর দেবার! এই বছর রিতার প্রথম উপন্যাস ‘বিনু’ প্রকাশিত হয়েছে। আরো কত কিছু করার আছে এখনও ওর।
জীবনের ভয়ংকর এই সত্যিটা রীতিমত দার্শনিকের নির্লিপ্ততা নিয়ে গ্রহণ করেছিল রিতা । আহমাদ মাযহার ভাই আজ বললেন, ‘জীবনের কঠিনতম সময়ে রিতা যেভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে একটার পরে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা সত্যি বিস্ময়কর। ওর কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’ লাইভ সাপোর্টে চলে যাওয়া রিতা যখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল বলে পরিচিত ম্যানহাটান শহরে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটল। সেখানে লোডশেডিং হল কয়েক ঘন্টার জন্য। যেটা গত কয়েক দশকে হয়েছে বলে কারো জানা নেই।
ওই লোডশেডিংয়ের সময় একজন মরণাপন্ন রোগী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আশ্চর্য্য ঘটনা হল, সেই মানুষটি তাঁর লিভার দান করে গিয়েছিলেন। আরো অলৌকিক ঘটনা যে সিরিয়ালে থাকা প্রায় ত্রিশ জন্ রোগীকে পিছনে ফেলে ওই লিভার রিতার সঙ্গে ম্যাচ করল। এরপর অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ অপারেশনের মাধ্যমে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করা হল।
দীর্ঘ অচেতন অবস্থা শেষে রিতা জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। প্রথম আলোর আরেক কর্মী রওশন হককে আজ সে জানিয়েছে, প্রিয় পত্রিকার কার্যালয়ে ফিরে আসতে চায়। এই হল সেই অলৌকিক কাহিনী। গল্প বা নাটকে এমন কাহিনী পড়লে বা দেখলে হয়ত কেউ বিশ্বাস করতে চাইতো না। কিন্তু বাস্তব যে তারচেয়েও বিস্ময়কর। আসলে রিতার কাছে প্রকৃতির অনেক ঋণ ছিল। তারই প্রতিদান দিল প্রকৃতি এভাবে।
লেখক-বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রীড়া সাংবাদিক