নিভে গেল বাতিঘর.....
।। তুহিন সানজিদ ।।
দিনটার কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যা। শহরের পাকাপুল মোড়ের পাশে বাটা শোরুমের উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলছিলেন সুভাষ দা (সুভাষ চৌধুরী)। কথা শেষ হতেই সামনে গিয়ে পা ছুয়ে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম-দাদা আমি সাংবাদিকতা করতে চাই, আপনার সহযোগিতা চাই, কি করতে হবে কিভাবে নিউজ লিখতে হবে কিছুই জানি না, আপনি যদি একটু হেল্প করতেন তাহলে আমি চেষ্টা করতাম। ছোট্ট একটা মুচকি হাসি দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন “একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় শিক্ষক তার নিজের পত্রিকা”, তুমি যে পত্রিকায় কাজ করছো বা করবা সেই পত্রিকার নিউজ বেশি করে পড়ো, আর নিউজ কালেকশান, নোট করা, সোর্স তৈরি করা আমি তোমাকে বলে দেব”। এই ছিল কিংবদন্তি সাংবাদিক সুভাষ দা’র সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
দাদার সাথে কথা বলবো বলে পোস্ট অফিস মোড় থেকে দাদাকে ফলো করছিলাম। বাসা থেকে প্রায়ই হেঁটে প্রেসক্লাবে যেতেন। খুব কাছাকাছি পেছনেই ছিলাম কিন্তু কথা বলার সাহস পাইনি। এরপর কথা বলতে বলতে প্রেসক্লাব পর্যন্ত গেলাম। সেই প্রথম প্রেসক্লাবে যাওয়া। একটি ছোট্ট টেবিল চেয়ারে বসে দাদা নিউজ লিখছে আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। কয়েকবার তিনি আমাকে বসতে বলেছেন, কিন্তু সাহস পাইনি। আধাঘন্টারও বেশি পরে লেখা শেষ হলে দাদা জানতে চাইলেন-কোন পত্রিকায় কাজ করছো তুমি ? বললাম-আজ দুপুরে কাফেলা পত্রিকায় একটি আবেদন করেছি পাটকেলঘাটা প্রতিনিধি হিসেবে। স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে বললেন-আচ্ছা ঠিক আছে, কাল বিকেলে এসো।
পরদিন দাদার বাসার ঠিকানা যোগাড় করে দুপুরের পর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পাঁচটার দিকে দাদা বাসা থেকে বেরিয়ে সামনে আসতেই প্রণাম করলাম। তারপর গল্প করতে করতে হেঁটে প্রেসক্লাব। এরপর অনেকটা দিন এভাবে দাদার বাসা থেকে গল্প করতে করতে প্রেসক্লাবে গিয়েছি। বাসায় নিয়ে পুরোনো অনেক দেশ কাঁপানো রিপোর্ট আমাকে দেখিয়েছেন, আমি সেগুলো লিখে নিয়েছি পড়ার জন্য, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লিখেছি। একদিন দাদা বলেছিলেন-”তোমার এই ধৈর্য আর পরিশ্রম জীবনে একদিন অনেক বড় কিছু উপহার দেবে “। আর পেয়েছিও তাই।
তারপর থেকে সুভাষ দা’র প্রত্যেকটা বিশেষ রিপোর্ট এবং ফিচার আমি কালেকশান করে রাখতাম।
সাতক্ষীরা ছেড়ে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকা চলে যাওয়ার কিছুদিন পর দাদার সাথে কথা হয়েছিল তার বাসার ল্যান্ডফোনে। জানিয়েছিলাম ঢাকায় আসার কথা। একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন-অভিমানী সিদ্ধান্ত তবে তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ, প্রবল ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও সাতক্ষীরা ছাড়তে পারলাম না তুহিন, কষ্ট করতে থাকো একদিন দেখবা ভালো কিছু হবেই। হয়েছেও তাই আমার জীবনে।
সাতক্ষীরা ছেড়ে ঢাকা যেতে পারলে সুভাষ চৌধুরী হয়তো অনেক বড় কোনো জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক হতে পারতেন। সেই মেধা ও যোগ্যতা ছিল তার। অনেকের চেয়ে একটু বেশি ছিল বললেও ভুল বলা হবে না। কিন্তু অজানা কারণে দাদা সাতক্ষীরা ছাড়তে পারেননি। কখনও ছাড়তে চেয়েছেন, আবার কখনও চাননি। হয়তো সাতক্ষীরায় থেকেই কলম দিয়ে যুদ্ধটা করতে চেয়েছিলেন তিনি। আর জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত করেও গেছেন সেটাই। তার কলমের খোঁচায় সাতক্ষীরা আর সুন্দরবনের অনেক কিছুই বদলে গেছে। দক্ষীনাঞ্চলের চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তার দুঃসাহসী লেখনি নতুন প্রজন্মের জন্য অনুকরনীয়।
সুভাষ চৌধুরী শুধু একটা নাম নয়, একটা প্রতিষ্ঠান। মফস্বল সাংবাদিকতার বাতিঘর। সেই আলোয় আলোকিত হয়েছেন অনেকেই। একদিকে সাহসী সাংবাদিক অন্যদিকে মানুষ গড়ার কারিগর। এই দুইয়ে মিলে সুস্থ্য সমাজ বিনির্মানে সুভাষ চৌধুরীর অবদান চিরদিন অম্লান থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে সেই অবদান।
বাতিঘরটি আরো কিছুদিন ধরে রাখতে পারলে আমরা আরো আলোকিত হতে পারতাম, আলোকিত হতো সমাজ তথা দেশ ও জাতি। আমাদের দুর্ভাগ্য বড্ড অসময়ে নিভে গেল আমাদের বাতিঘরটি। ওপারে ভালো থাকবেন সুভাষ দা। আমাদের বিশ্বাস ওপারের অজানা জগতটিও আলোকিত হবে আপনার মেধা, জ্ঞান আর লেখনির আলোয়।
তুহিন সানজিদ
নির্বাহী সম্পাদক, দি নিউইয়র্ক মেইল