দেখে আসুন প্রেমের নিদর্শন তাজমহল
কথায় আছে প্রেমের অপর নাম তাজমহল। তাই প্রেম-পিয়াসি মানুষ যদি জীবনে একবার তাজমহল না দেখে থাকেন তবে প্রেমের মর্ম পুরোপুরি বুঝার ব্যাপারটাই কিছুটা অপূর্ণ থেকে যায়।পৃথিবীজুড়ে প্রেমের প্রতীক হিসেবে পর্যটকদের কাছে এক অনন্য দর্শনীয় স্থান তাজমহল।
তাজমহলের সামনে দাঁড়ালে, নিজের অজান্তেই দু’চোখের পাতা ভিজে যায়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টি। যার কোন উপমা নেই। উৎপ্রেক্ষা নেই, নেই চিত্রকল্প। যার খ্যাতি শুধু বিশ্বজোড়া।
এটি সম্রাট শাহজাহানের মহা, অমর ও অনবদ্য এক কীর্তি যা তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে ভালবেসে তৈরি করেছিলেন। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ভালবাসার এত বড় নিদর্শন কেউ তৈরি করে দেখাতে পারেননি। ভাবতেই যেন অবাক লাগে ২০ হাজার শ্রমিক ২২ বছর সময় নিয়ে তাদের নিপুন হাতে এ মহাকীর্তিটি নির্মাণ করেছেন।
তাজমহল দেখার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রত্যহ ভিড় জমায় হাজারো পর্যটক। বর্তমানে তাজমহলে বছরে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন পর্যটক আসে যার মধ্যে দুই লাখ পর্যটক বিদেশী। এটি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র।
১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ পর্যটক এবং রাজদূত এডওয়ার্ড লিয়ার আগ্রার তাজমহল দেখে বলেছিলেন, আজ থেকে বিশ্ববাসীকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হোক। একটা শ্রেণী যারা তাজমহল দেখেছে এবং আরেকটি শ্রেণী যারা দেখেনি। তার এই উক্তিটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তার উক্তির জন্যই নয়, আরও অনেক কিছুর জন্যই তাজমহল দেখে আসতে পারেন।
শাহজাহানের স্ত্রীর নাম কিন্ত মমতাজ ছিল না। তার নাম ছিল আরজুমান্দ বানু বেগম। তাকে ভালবেসে মমতাজ ডাকতেন সম্রাট শাহজাহান। রাজকার্য থেকে শুরু করে সামরিক অভিযান সব কিছুতেই শাহজাহানের সঙ্গী ছিলেন মমতাজ। ১৮ বছরের দাম্পত্যজীবনে তাদের ঘরে আসে ১৪টি সন্তান। ১৬৩০ সালে সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু হয় মমতাজের। মৃত্যুর আগে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে নেন ৪টি প্রতিশ্রুতি। তাঁদের ভালবাসার স্মৃতিকে অমর করে রাখবে এমন একটি স্থাপনা নির্মানের প্রতিশ্রুতি ছিল তার অন্যতম। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সম্রাট তাজমহলের নির্মাণ কাজ হাতে নেন। ১৬৩১ সালে এর নকশা চূড়ান্ত করেন। আর ২২ বছর সময় নিয়ে ১৬৫৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শেষ করেন অপূর্ব সৌধটির নির্মাণ।
অপরূপ সৌন্দর্যের এ সৌধটি নির্মাণে ব্যয় হয় সেই সময়ের প্রায় ৩২ মিলিয়ন রুপি। দিল্লি, কান্দাহার, লাহোর এবং মুলতানের সুদক্ষ কারিগররা নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। আর এর তাজের বিশেষ কাজগুলো করেন বাগদাদ, শিরাজ ও বোখরার দক্ষ মুসলিম নির্মাতারা। নির্মাণ কাজের প্লেটে নির্মাতাদের প্রধান হিসেবে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ মুসলিম স্থপতি ওস্তাদ ঈসা খাঁয়ের নাম লিখা রয়েছে।
একটি বর্গাকার ক্ষেত্রের প্লাটফর্মের ওপর তাজমহলটি অসমান অষ্টভুজাকৃতির আকার ধারণ করেছে। বড় গম্বুজের উপর মুকুটের মত একটি পুরনো মোচাকার চূড়া আছে। চূড়াটি ১৮০০ শতকের আগে স্বর্ণের নির্মিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি। এই চূড়াটিই পারস্যদেশীয় এবং হিন্দুদের শোভাবর্ধক উপাদানের মিলনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। চূড়ার উপরের অংশে আছে একটি চাঁদ, যা ইসলামিক নিদর্শন এবং চূড়ার শিং তাঁক করা আছে স্বর্গ বা বেহেস্তের দিকে। বড় গম্বুজের উপর চূড়ার চাঁদ এবং তাঁক করা শিং মিলে একটি ঐতিহ্যবাহী চিহ্নের আকার ধারণ করে, যা হিন্দু দেবতা শিব এর চিহ্নের মত।
এটি নির্মিত হয়েছে সারা এশিয়া ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা উপাদান দিয়ে। এরমধ্যে আলো প্রবাহী সাদা মার্বেল আনা হয়েছিল রাজ্যস্থান থেকে। ইয়াশম, লাল, হলুদ ও বাদামী পাথর পাঞ্জাব থেকে, সবুজ পাথর ও স্ফটিক টুকরা চীন থেকে আনা হয়েছে। বৈদূর্য মনি ও সবুজ-নীলাভ রত্ন তিব্বত থেকে, নীলকান্ত মনি আফগান থেকে, উজ্জ্বল নীল রত্ন শ্রীলঙ্কা থেকে এবং রক্তিমাভ, সাদা ও খয়েরি রঙের মূল্যবান পাথর আনা হয়েছিল আরব থেকে। এতে মোট আটাশ ধরণের মূল্যবান পাথর বসানো হয়েছে সাদা মার্বেলের ওপর। আর নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল এক হাজারের বেশি হাতি।
চমৎকার এ সমাধী সৌধটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। গেট পেরিয়ে মূল ফটকে যেতে বেশ খানিকটা পথ পায়ে হেটে পারি দিতে হবে। এরপর মূল বেদিতে পৌঁছতে নিচ থেকে ২১টি চমকপ্রদ সিঁড়ি পার হতে হবে। শুধু সমাধি সৌধ নয় সম্পূর্ণ তাজমহলের বেষ্টনি ও এর আশপাশ যেন এক স্বপ্ন রাজ্য।
কথিত আছে, তাজমহল নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই পূত্র আওরঙ্গজেবের হাতে কারাবরণ করেন শাহজাহান। তার মৃত্যুর পর তাকে তাজমহলে স্ত্রী মমতাজের পাশে শায়িত করা হয়। এটি তাজমহলের নকশার একমাত্র অসংগতি। কারণ মূল নকশায় ঘরটির মাঝে শুধু একটি কবর ছিল। ১৯ শতকে তাজমহল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সৈন্যরা তাজমহলে খচিত নীলকান্ত মণিসহ অন্যান্য দামী রত্ন ও স্বর্ণ লুট করে এর অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধন করে। যদিও পরবর্তীতে লর্ড কার্জন তাজমহলের সংস্কার করেন, কিন্তু তিনি এর বাগানের নকশার কিছু পরিবর্তন করে ফেলেন।
বর্তমানে তাজমহলকে সরকারি তত্ত্বাবধানে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো তাজমহলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভূক্ত করে।
যেভাবে যাবেন:
আপনি যদি আকাশপথে যেতে চান, তাহলে প্রথমে আপনার দেশ থেকে থেকে দিল্লি। তারপর দিল্লি থেকে আগ্রা যেতে পারেন। তবে আপনি যদি স্থলপথে যেতে চান তাহলে আপনি শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টার থেকে সৌহার্দ্য বাসের টিকেট নিতে পারেন। টিকেটের মূল্য জনপ্রতি এক হাজার ৭০০ টাকা। তবে কলকাতার টিকেট আপনি পাবেন কমলাপুর ও শ্যামলী থেকে।
কলকাতায় যেয়ে ফেয়ারলি প্লেস নামক জায়গায় যেতে পারেন। ট্যাক্সি আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবে। ফেয়ারলি প্লেস থেকে সরকারি সহায়তায় বিদেশিদের সুলভমূল্যে টিকেট কেটে দেওয়া হয়। সেখান থেকে আগ্রার ট্রেন টিকেট কেটে নিন। এখানকার কর্মকর্তারা অত্যন্ত আন্তরিক, তারা আপনাদের যথেষ্ট সহায়তা ও তথ্য দেবেন। ট্রেন ও সিটের ওপর ভিত্তি করে টিকেট মূল্য হয়ে থাকে, তবে ৮০০-৩৪০০ টাকা পর্যন্ত টিকেটের মূল্য হতে পারে।
কলকাতা থেকে ট্রেনে আগ্রা পৌঁছাতে প্রায় ৩৪-৩৬ ঘণ্টা লেগে যায়। তবে এখন কলকাতা থেকে আগ্রা সুপার ফাস্ট ট্রেনসেবা চালু হয়েছে, যা আরো দ্রুত পৌঁছায়। তবে ট্রেনে আপনার একটুকুও খারাপ লাগবে না, কারণ সিটগুলো স্লিপার কোচ হয়ে থাকে এবং ট্রেনেই সুলভমূল্যে ভাত-মাংস-সমুচা-খিচুড়ি-বিরিয়ানির মতো খাবারের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া ট্রেনের জানালা দিয়ে কখনো পাহাড়, কখনো তৃণভূমি, কখনো বা বন আপনাকে মুগ্ধ করবে।
কোথায় থাকবেন:
আগ্রা পর্যটন এলাকা হওয়াতে এখানে অনেক ভালো হোটেল রয়েছে। আগ্রা স্টেশনে নেমে স্টেশন থেকে বের হয়ে অনেক বেবি ট্যাক্সি দেখতে পাবেন তারাই আপনাকে নানা হোটেল ঘুরে দেখাবে। আগ্রায় আপনি ১২০০-২৫০০ রুপির মধ্যে ভালো হোটেল পেয়ে জাবেন। তবে এর চেয়ে বেশি দামের হোটেলও রয়েছে এখানে। যা দেখতে পাবেন.
কখন যাবেন:
আগ্রা যাওয়ার উপযুক্ত সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। খুব গরমে আগ্রা না যাওয়াই ভালো।
যা খাবেন:
এখানে বিরিয়ানি, বিভিন্ন মোগলাই খাবার খেতে পারেন।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।
নিউইয়র্ক মেইল/ভারত/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম