প্রকৃতির সবুজের সমারোহ পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’
পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে পারেন জীববৈচিত্রে ভরপুর পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে। ময় কাটাতে পারেন হরিণ দেখে, বাঘ খুঁজে, বানর ও কুমিরের সাথে লুকোচুরি খেলে। কিংবা নির্জন বনের সৈকতে গোসল ও সাঁতার কেটে নিতে পারেন।
এছাড়াও দু’চোখ ভরে দেখতে পারেন সবুজের সমারোহে ঘেরা সুন্দরবনের নানা দর্শনীয় স্থান-করমজল, কটকা, কচিখালী, পক্ষীর চর, ডিমের চর, তিনকোনা, হারবাড়িয়া, কোকিলমোনি, হিরণপয়েন্ট, দুবলারচর ও আলোরকোল। মূলত এই স্পটগুলোর প্রতিই থাকে সুন্দরবন ঘুরতে আসা পর্যটকদের মূল আকর্ষণ।
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি। ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের আকর্ষণ দুর্নিবার। বার্ড ওয়াচিং, এ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং, ক্যানেল ক্রুজিং সহ জীবজন্তু দেখা- একসাথে এতকিছু উপভোগের সুযোগ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনেই পাওয়া যায়। তাই প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে চাইলে আপনিও পরিবাবের সবাইকে নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন ম্যানগ্রোভ বনভূমি।
কী আছে সুন্দরবনে?
সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদার চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপ মালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল ও জনাকীর্ণ অঞ্চল। বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত সুন্দরবন।
নদীতে কুমির ও ভয়াল অজগরসহ প্রায় ৩৩ প্রজাতির সরীসৃপ বাস করে সুন্দরবনে। এছাড়াও শীতকালে অসংখ্য অথিতি পাখির আগমন ঘটে এখানে। আর গাছের মধ্যে সুন্দরী, কেওড়া, গরান, বাইন, গেওয়া, পশুর, গোলপাতা, হেতাল, কাঁকড়া, ঝানা, সিংড়া, খলসা ইত্যাদি।
সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ক্যামেরার সাহায্যে বন্য জন্তুর ছবি তোলার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ ছাড়াও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর দর্শন সহজলভ্য। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচ্য।
জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালদের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার সুযোগ পেতে পারেন অনায়াসেই। রাতের সুন্দরবনের শান্ত স্নিগ্ধ রূপ আর নদী সমুদ্রের সৌন্দর্য অপরূপ। এসব ছাড়াও সুন্দরবনের আশপাশে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন আকর্ষক স্থানসমূহ।
হিরণপয়েন্ট: হিরণ পয়েন্ট পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম স্থান। ভাগ্যে থাকলে এখান থেকে বাঘ, হরিণ ও নানা জাতের পশুপাখি দর্শনের সুযোগ পেতে পারেন। এখানে বানর, কুমির ছাড়াও নানা প্রজাতির পাখি দেখতে পারবেন। প্রকৃতির নানা সৌন্দর্য যেন ছড়িয়ে রয়েছে এর আশপাশে।
কটকা-কচিখালি: কচিখালি এলাকার সংলগ্ন সমুদ্র তীরবর্তী অংশের তৃণভূমি জাতীয় বনভূমি ১২০ বর্গমাইল এলাকায় কটকা-কচিখালি অভয়ারণ্য অবস্থিত। এই বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে প্রায় সারা বছর বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী নির্ভয়ে বিচরণ করে। এখানে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে।
দুবলারচর: এটি একটি নয়নাভিরাম দ্বীপ। এখানে চিত্রল হরিণের দল ঝাঁকে ঝাঁকে চরতে দেখা যায়। এই দ্বীপকে দুবলার ট্যাকও বলা হয়। দুবলার মাটি খুঁড়লে মিষ্টি পানি পাওয়া যায়। দুবলার চর কটকা কিংবা হিরণ পয়েন্টের চেয়ে আরও মনোরম জায়গা। কার্তিক মাসে এখানে মেলা বসে। এখানে এ সময় প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। এই মেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা দেবতা নীলকমল ও গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে থাকে।
অভয়ারণ্য: প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রতিবছর সুন্দরবনের অনেক দুষ্প্রাপ্য প্রাণী সম্পদের বিলুপ্তির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার গাছ ও উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটেছে। বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ বংশবিস্তার ও নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে বনের নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সরকার অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে সুন্দরবনে এরূপ তিনটি অভয়ারণ্য রয়েছে। এগুলো হলো কটকা রুচিখালি অভয়ারণ্য, নীলকমল অভয়ারণ্য ও পশ্চিম অভয়ারণ্য। নীলকমল অভয়ারণ্য হিরণ পয়েন্ট ও নীলকমল এলাকায় পর্যটকদের খুবই আকর্ষণীয় স্থান। ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ এ এলাকায় বিচরণ করে। ১১০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এটি বিস্তৃত। মংলা বন্দর থেকে এখনে যেতে ৬/৭ ঘণ্টা সময় লাগে।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে সরাসরি খুলনা দূরপাল্লার পরিবহন বাসে। এরপর মংলা বন্দর বা খুলনা নতুন বাজার লঞ্চঘাট থেকে সুন্দরবন যাওয়া যায়। সুন্দরবন যেতে প্রাইভেট মোটর, লঞ্চ, স্পিড বোট, নৌ বা মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের যান ভাড়া করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
ঢাকা থেকে প্লেনে যশোর, সেখান থেকে সরাসরি খুলনা কিংবা সদরঘাট থেকে গাজী ও শাহীন বেলায়েত নামক রকেটে খুলনা যাতায়াত করা হয়। বাসে ঢাকা থেকে খুলনায় যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি আধুনিক ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন বাস চালু আছে।
কোথায় থাকবেন:
হিরণ পয়েন্টে মংলাপোর্ট কর্তৃপক্ষের আরামদায়ক ত্রিতল বিশিষ্ট রেস্টহাউস রয়েছে যেখানে ৮ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। অগ্রিম প্রদান সাপেক্ষে খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এছাড়া ট্যুর অপারেটর নিজেদের উদ্যোগেই থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন।
মনে রাখবেন:
খুলনা ও এর দক্ষিণাঞ্চলের সব পানি লবণাক্ত। তাই পূর্বেই পর্যাপ্ত সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত তথ্য:
সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার অবারিত নয়। সংরক্ষিত বনাঞ্চল বলে বনবিভাগের অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক। বিনা অনুমতিতে সুন্দরবনে ঢোকা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুন্দরবনে ভ্রমণ করতে হলে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার বাগেরহাট বা ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার খুলনা বরাবরে দরখাস্ত করে অনুমতি নিতে হয় এবং প্রয়োজনীয় ফি প্রদান করতে হয়।
সঙ্গে নিতে ভুলবেন না:
ট্রাউজার, টি-শার্ট, শর্টস, ক্যানভাস সু, প্রয়োজনীয় ওষুধ, স্পিলার তোয়ালে, টুথপেস্ট, ব্রাশ, শেভিং ক্রিম, সানস্ক্রিন, বাইনোকুলার, ক্যামেরা, ফিল্ম, টর্চ, ব্যাটারি, হ্যাট অথবা ক্যাপ। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা যাবে না।
নিউইয়র্ক মেইল/বাংলাদেশ/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এইচএম