সহিংস রুপ নিতে পারে কাতালুনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন
কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার দাবীতে চলমান আন্দোলন ধীরে ধীরে সহিংস রূপ ধারণ করছে। আন্দোলনকারীরা রাস্তা বন্ধ করে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন এই আন্দোলন ধীরে ধীরে সহিংসতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ ৯ কাতালান নেতাকে গ্রেফতার করেছে। বিদেশে পালিয়ে যাওয়া আরো ৬ কাতালান নেতাকে গ্রেফতার করে স্পেনে আনার জন্য আন্তর্জাতিক পরোয়ানা জারি করেছে। এর মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস পুজদেমন জার্মানিতে গ্রেফতার হবার পর তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
বার্সালোনার একটি স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বার্তা বারবেট জানিয়েছেন, এই ঘটনা কট্টরপন্থী স্বাধীনতাকামীদের সহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে নিয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু সংঘর্ষ এবং একই সাথে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে তাই বাস্তবসম্মতভাবেই কট্টরপন্থার সুযোগ বেড়ে গেছে’। তবে বারবেট মনে করেন না স্পেনে বাস্ক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ ইটিএ বা কাতালান সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী দল তেরা লিলউয়ারের মতো কোন দল গড়ে উঠতে পারে। ইটিএ’র বিরুদ্ধে বোমা বিষ্ফোরণ করে প্রায় ৮০০ মানুষ হত্যার অভিযোগ আছে। তবে দলটি ২০১৭ সালে অস্ত্র সমর্পন করে। আর তেরা লিলউয়ার ১৯৮৭ সালে বিষ্ফোরন ঘটিয়ে মাত্র একজনকে হত্যা করে। কাতালান জাতিয়তাবাদী এই গ্রুপটি ১৯৯৫ সাল থেকে শান্তি প্রক্রিয়ার মাঝেই আছে।
তবে পুজদেমনের গ্রেফতারের পর কাতালুনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে আবারও সহিংসতার প্রবণতা বেড়ে গেছে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১০০ এর অধিক মানুষ আহত হয়েছেন। মাদ্রিদের নির্দেশে কাতালান পুলিশ বিক্ষোভকারীদের টিয়ার গ্যাস ছুঁড়লে এবং লাঠিচার্চ করলে এই আহতের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীদের পুলিশের দিকে কাঁচের বোতল, কোমল পানীয়ের ক্যান এবং ডিম ছুঁড়তে দেখা গেছে। কট্টরপন্থী আন্দোলনকারীরা এই আন্দোলনকে ‘কাতালান বসন্ত’ নামে ঘোষণা করেছে।
এদিকে আন্দোলনকারীরা একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছি যেখান থেকে আর ফেরা যায়না। আমরা সকল রাস্তাঘাট বন্ধ রাখবো এবং পুরো দেশকে অচল করে দেবো’।
আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভকারীরা পর্যটন শহর বার্সালোনার সকল গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থাপনায় যাবার পথ বন্ধ করে রেখেছে।
প্রসঙ্গত, স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের বাধা উপেক্ষা করে ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর, গণভোটের আয়োজন করে কাতালোনিয়া। এতে ৯০ শতাংশ ভোটার কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন। এটি অনুমোদন করে কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট। স্পেনের সাংবিধানিক আদালত এই পার্লামেন্টকে বরখাস্ত করেছিল। তবে, স্পেন সরকার এই গণভোটকে বেআইনি ও অসাংবিধানিক হিসেবে অভিহিত করে এসেছে।
ভোট দেওয়ার জন্য কাতালোনিয়ার অধিবাসীরা ভোটকেন্দ্রে যাওয়া চেষ্টা করলে তাতে বাধা দিয়েছিল স্পেনের জাতীয় পুলিশ বাহিনী। কাতালান কর্তৃপক্ষের দাবি, গণভোটে অংশ নেওয়া ভোটারদের মধ্যে ৯০ শতাংশের কিছু কম মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছে। যদিও মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪৩ শতাংশ গণভোটে অংশ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ অক্টোবর ২০১৭ কাতালান পার্লামেন্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। পার্লামেন্টে স্বাধীনতার পক্ষে ৭০টি ভোট পড়ে, বিপক্ষে পড়ে ১০ টি।
তবে স্পেনের সরকার সেই স্বাধীনতা প্রত্যাখ্যান করে। একইসঙ্গে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত কাতালোনিয়া সংসদের স্বাধীনতা ঘোষণাকে অবৈধ ঘোষণা করে, দেশটির আঞ্চলিক নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্ব কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেয়নি।
স্পেন থেকে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর ক্রমবর্ধমান সংকটে দেশটির অন্যতম সম্পদশালী অঞ্চলের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।
স্পেনের অর্থনীতির ‘পাওয়ার হাউস’ খ্যাত কাতালানের ব্যবসা ও সম্পদের কিছু তথ্য তুলে ধরা হল-
ধনী অঞ্চল : স্পেনের সম্পদশালী অঞ্চলের তালিকায় কাতালোনিয়া মাদ্রিদকেও পেছনে ফেলেছে। ২০১৬ সালে স্পেনের জিডিপির ১৯ ভাগের জোগান দেয় কাতালান। স্পেনের ১৭টি অঞ্চলের মধ্যে মাথাপিছু আয়ে কাতালানের অবস্থানে শীর্ষ চতুর্থ স্থানে। ২০১৭ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের হিসাব অনুসারে বেকারত্বের হার দেশটির গড় হার ১৩.২ ভাগের চেয়ে কম। স্পেনের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কাতালান স্বাধীন হলে দেশটির জিডিপি এক-চতুর্থাংশ কমে যাবে এবং বেকারত্ব দ্বিগুণ হবে। স্বাধীনতাকামীরা বলছেন, মাদ্রিদকে কর দিতে না হলে কাতালানের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
শীর্ষ রফতানিকারক : কাতালান এখন পর্যন্ত দেশটির শীর্ষ রফতানিকারক অঞ্চল। গত বছর দেশটির রফতানি আয়ের এক-চতুর্থাংশই আসে কাতালান থেকে। ২০১৫ সালে স্পেনের বিদেশি বিনিয়োগের ১৪ ভাগই পায় কাতালান। মাদ্রিদের পরই ছিল এ অঞ্চলের অবস্থান। কাতালানে খাদ্য, রাসায়নিক এবং লজিস্টিক খাতের বৃহৎ কোম্পানি রয়েছে। ২০১৬ সালে স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম গাড়ি উৎপাদনকারী অঞ্চল ছিল কাতালান। নিশান ও সিয়াটের কারখানা রয়েছে এখানে। তবে চলমান সংকটের কারণে ৮০০ কোম্পানির সদর দফতর কাতালান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি : নব্বইয়ের দশক থেকে জীববিজ্ঞান, জেনটিক্স, নিউরোসায়েন্স এবং সেল জীববিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে কাতালান। এখানে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র। বলা হয়, মাথাপিছু হিসেবে ইউরোপের ওষুধ কোম্পানির শীর্ষে রয়েছে কাতালান। স্পেনের সেরা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটিই কাতালানে।
পর্যটকদের কাছ ব্যাপক জনপ্রিয় : প্রাদেশিক রাজধানী বার্সোলো ও কোস্টা ব্রাভা সৈকত পর্যটকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। স্পেনের অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে কাতালান পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। গত বছর কাতালান পরিদর্শন করেন ১ কোটি ৮০ লাখ লোক, যা স্পেনের মোট বিদেশি পর্যটকের এক-চতুর্থাংশ। তবে চলমান সংকটের কারণে পর্যটকদের সংখ্যা প্রায় ১৫ ভাগ কমে গেছে।
ঋণের পাহাড় : ২০১৭ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে স্পেনের অঞ্চলগুলোর মধ্যে কাতালান ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণগ্রস্ত। অঞ্চলটির ঋণ প্রায় ৯ হাজার কোটি ডলার। জিডিপির ৩৫ ভাগ ঋণ রয়েছে কাতালানের। রেটিং সংস্থাগুলো কাতালানকে তলানিতে রেখেছে, যার মানে হচ্ছে ঋণ পেতে কাতালান সরকারকে স্পেন সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়।