ফিলিস্তিনিদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ইসরাইলি বর্বরতা
ফিলিস্তিনের বাতাসে শুক্রবারে ছিল কাঁদানে গ্যাস ও টায়ার পোড়ার গন্ধ। আর থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ লক্ষ্য করে ছোড়া ইসরাইলি বাহিনীর কামানের গর্জন।
গাজা উপত্যকায় দ্বিতীয় সপ্তাহের মতো নিরপরাধ নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর ইহুদিবাদী ইসরাইলি সেনাদের নির্বিচার গুলিতে ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
যাদের মধ্যে দুটি কিশোর ছেলেও ছিল। এতে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।
গত সপ্তাহের চেয়ে এবারের বিক্ষোভে অংশগ্রহণ ছিল কম। তবে সেই তুলনায় হতাহত বেশি। তখন ২১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল দখলদার সেনারা।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস দাবি করেছে, তাদের বিক্ষোভ ছিল পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র। জ্যেষ্ঠ হামাস নেতা মাহমুদ আল জাহার বলেন,আজ আমরা সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে চাচ্ছি যে, আমাদের লড়াইয়ে কোন অস্ত্র ও বন্দুকের ব্যবহার ছিল না।
তিনি বলেন, আমরা অপেক্ষা করছি, বিশ্ববাসী আমাদের বার্তা গ্রহণ করে ইসরাইলকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে চাপ দেয় কিনা, তা দেখার জন্য।
হুশিয়ারি উচ্চারণ করে মাহমুদ আল জাহার বলেন, বিশ্ব যদি সেক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তখন দখলদারদের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ব্যবহারে বাধ্য হব।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, ফিলিস্তিনিদের অনুপ্রবেশ বন্ধে ও সীমান্তের বেড়া রক্ষা করতে তারা তাজা গুলি ব্যবহার করে যাবে।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিরা সীমান্তের বেড়া অতিক্রম করে তাদের পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটিতে যেতে চাইলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নির্বিচার গুলি চালিয়ে তাদের ঠেকাতে চাইছে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। শিশুদের চিৎকার করে কাঁদতে দেখা গেছে। আর বুলেট থেকে নিজেদের বাঁচাতে পরিবারগুলো গাড়ির আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
২৬ বছর বয়সী বিলাল আবু জাহের বলেন,আমি মনে করি, আমাকে সীমান্তের ওই বেড়া অতিক্রম করতে হবে। যদি তারা গুলি করে আমার বুক ঝাঝরা করে দেয় কিংবা আমাকে কেটে দুই টুকরা করে দেয়, তবুও আমি যাব।
একটি ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। ২০০৮ সালে ইসরাইলি বিমান হামলায় তাদের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও হাঁটচলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
তিনি বলেন,বৃহস্পতিবার ইসরাইলি সেনাবাহিনী তার হুইলচেয়ারে গুলি করেছে। এতে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু শুক্রবার তিনি আবার সীমান্ত বেড়ার কাছে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে এসেছেন।
তিনি বলেন, আমি নিজের সম্মান ও মর্যাদার জন্য এখানে এসেছি। আমাকে আমার ভিটেমাটিতে ফিরে যেতেই হবে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিক সমিতি জানায়, ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে তাদের সাত সাংবাদিক আহত ও জখম হয়েছেন। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, এতে একজন সম্প্রচার সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস আন্দোলন। এরপর থেকে ইসরাইল উপত্যকাটি জল-স্থল-আকাশ পথে অবরুদ্ধ করে রাখছে। বিক্ষোভকারীরা এই অবরোধ ভেঙে দিতে চাইছেন।
ছয় সপ্তাহজুড়ে ঘরে ফেরার এই বিক্ষোভ চলবে ১৫ মে পর্যন্ত। ১৯৪৮ সালে সশস্ত্র ইহুদিবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের জাতিগত নির্মূল অভিযানে সাত লাখ ফিলিস্তিনি প্রাণ বাঁচাতে বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন।
শুক্রবারের বিক্ষোভ এটা পরিষ্কার করে দিয়েছি, ফিলিস্তিনিরা অন্তত তাদের একটি লক্ষে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। হামাস ও পশ্চিমতীর ভিত্তিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ টানতে পেরেছেন।
শেষ পর্যন্ত এটাই প্রমাণিত হতে যাচ্ছে যে গাজা হচ্ছে কেবল একটি কারাগার। আর ইসরাইলিরা হচ্ছে জেলার ও কারারক্ষী।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া ফিলিস্তিনিরা পতাকা হাতে নিয়ে দলে দলে সীমান্তের বেড়া কাছে গিয়ে স্লোগান দিয়েছেন। পতাকার আদলে ঘুড়ি বানিয়ে উড়িয়েছেন। টায়ার স্তূপ করে তাতে অগ্নিসংযোগ করেছেন।
আর বিপরীত থেকে তাদের লক্ষ্য করে উড়ে উড়ে এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। গতকালের বিক্ষোভে শত শত নতুন বিক্ষোভকারী অংশ নিয়েছিলেন।
জাতিসংঘ দুই পক্ষকে সহিংসতা এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, গত সপ্তাহে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছিল বলে স্পষ্ট আলামত রয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল বলেন, নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীরা, যারা ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য ন্যূনতম হুমকি হিসেবে দেখা দেননি, তারাও ব্যাপকহারে হতাহত হয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা সীমান্ত বেড়া থেকে পালিয়ে এসেছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বিক্ষোভকারীকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখা গেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, আসন্ন মৃত্যু হুমকি কিংবা মারাত্মক আহত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, বেড়ার কাছে চলে আসা কিংবা সবুজ রেখা পার হওয়ার মানে এই নয় যে তারা প্রাণ হরণ ও মারাত্মক জখম আশঙ্কার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তাজা গুলির ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, যদি সেখানে অন্যায় ও বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের আশ্রয় নেয়া হয়, যা প্রাণ হরণের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে,তবে সেটা ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের শামিল। সেটা চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন।
নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদফতরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ এইচ. মানসুর এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছু করতে নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ হয়েছে। গত সপ্তাহের সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি প্রদানের ভোটাভুটিতেও অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা মনে করি নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মানে হল, আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে ইসরাইলকে উৎসাহিত করা।