কাঁধে স্বজনের লাশ, তবু লড়াকু ফিলিস্তিনিরা
ইসরাইলের গুলিতে নিহত ১০ ফিলিস্তিনির দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার গাজায় তাদের কবর দেয়া হয়।
প্রতিটি লাশ জানাজা থেকে কবর দেয়া পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছে শত শত ফিলিস্তিনির শোক মিছিল।
শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলো অশ্রুসজল চোখে দেখেছে তাদের স্বজনদের প্রতি স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি জনগণের আবেগ ও ভালোবাসার আন্তরিকতা।
তারা দেখেছেন, কীভাবে শহীদের প্রতি ছোট ছোট বাচ্চা থেকে বয়স্ক মানুষ তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকায় ঢাকা লাশের কফিনে।
অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের দখল করে নেয়া ঘরবাড়ি উদ্ধারে গত ৩০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া 'মার্চ ফর রিটার্ন' বা ঘরে ফেরা কর্মসূচি শুরু হয়েছে।-খবর নিউ ইয়র্ক টাইমস ও এএফপির।
এ কর্মসূচি ঘিরে গত শুক্রবার গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে এই ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৪৯১ জন। এ নিয়ে ইসরাইলি বর্বরতায় গত ৯ দিনে ২৯ ফিলিস্তিনি নিহত হলেন।
তবে একের পর এক স্বজনকে হারালেও ফিলিস্তিনিরা মনোবল হারাননি। তারা ইসরাইলি সেনাদের গুলির হুমকি উপেক্ষা করেই গাজা সীমান্তে জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখিয়ে যাচ্ছেন।
গত শুক্রবারের বিক্ষোভে অন্তত ২০ হাজার গাজাবাসী অংশগ্রহণ করেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ইসরাইলি বাহিনী কাঁদানে গ্যাস ও তাজা গুলি ব্যবহার করেছে।
এই দিনটিকে ফ্রাইডে অফ টায়ারস প্রটেস্ট বা টায়ার পুড়িয়ে বিক্ষোভ নামে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
গাজা সীমান্তে টায়ার জ্বালিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ এ বিক্ষোভে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরাইল।
তরুণ গাজাবাসী এখন ফ্লাওয়ার ফ্রাইডে বা ফুলসজ্জিত শুক্রবার ও কফিন শুক্রবার পালনের বিষয়ে কথা বলেছেন।
এমনকি তারা একটি জুতাময় শুক্রবার পালনের বিষয়েও আলোচনা করেছেন। যেদিন ইসরাইলের সেনাদের লক্ষ্য করে কেবল জুতা নিক্ষেপ করা হবে।
এভাবে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সেনাবাহিনীর গুলির সামনে বুক পেতে তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার প্রতিজ্ঞা করেছেন গাজাবাসী।
ইসরাইলি অবরোধ ভাঙতে ফিলিস্তিনিরা এখন অহিংস আন্দোলনকে বেছে নিয়েছেন। তারা জানে, ইসরাইলিরা তাদের প্রতি নিষ্ঠুর হামলা দিয়ে তার জবাব দেবে। এতে তাদের নিহতের সংখ্যা কমার সম্ভাবনাও নেই।
কিন্তু তাদের এ আন্দোলন এখন আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।
ইসরাইল দাবি করেছে, প্রায় ২০ হাজার বিক্ষোভকারী সীমান্ত বেড়া ভেঙে অনুপ্রবেশ করতে চেয়েছেন।
ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বিক্ষোভকারীরা মানবাধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু তারা মূলত ইহুদি রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলতে চেয়েছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার ৩০ বছর বয়সী ইয়াসের মুরতাজা নামে এক ফটো সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তিনি গাজাভিত্তিক আইন মিডিয়ায় কাজ করতেন।
গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার পর মৃত্যু হয়েছে ইয়াসেরের। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, প্রতিবাদের সময় তিনি বিক্ষোভকারীদের সামনে ছিলেন।
তিনি আহত হওয়ার পর সংবাদ সংস্থা এএফপির ছবিতে দেখা গেছে, তার পরনে ইংরেজিতে বড় করে প্রেস লেখা নেভি ব্লু রঙের সুরক্ষা জ্যাকেট ছিল। তার পেটে গুলি লেগেছিল বলে জানা গেছে।
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক আশরাফ আবু ওমর বলেন, তিনি ইয়াসেরের পাশে ছিলেন। তারা দুজনই হেলমেট ও সুরক্ষা জ্যাকেট পরে ছিলেন।
তিনি বলেন, আমাদের জ্যাকেটে বড় বড় করে প্রেস লেখা ছিল। আমরা সীমান্ত বেড়া থেকে প্রায় আড়াইশ মিটার দূরে বিক্ষোভকারীদের টায়ার পোড়ানো ছবি তুলছিলাম।
এর পর হঠাৎ করে ইসরাইলি সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করলে আমি ও ইয়াসের দৌড় দিই। তখন গুলি লেগে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহতদের জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, একজন সাংবাদিক যখন ইসরাইলি অবরোধের সত্যিকার দৃশ্য তুলতে গিয়েছেন, নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের ছবি তুলতে চেষ্টা করেছেন, তখন তার ওপরও হামলা চালানো হয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) সেক্রেটারি ক্রিস্টোফার দেলিয়োর বলেন,ইয়াসেরকে গুলির লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।
সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে ইসরাইলি বাহিনীর গোলাবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে তিনি এ ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছেন।
গাজা অধিবাসীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে উত্তর ইসরাইলে কয়েক হাজার আরব মিছিল করেছেন। তাদের কারও কারও হাতে নিহত ইয়াসেরের ছবি ছিল।
৩০ মার্চ শুরু হওয়া এই ঘরে ফেরার বিক্ষোভ আগামী ১৫ মে পর্যন্ত প্রতি শুক্রবার পালন করা হবে। শেষ দিন এটি ব্যাপক বিক্ষোভের রূপ নিতে পারে।
প্রথম দিনের বিক্ষোভে ৩০ হাজার বিক্ষোভকারী অংশ নিয়েছিলেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে সেদিন ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হন।
ভিডিওতে দেখা গেছে, তাদের অনেকেই সীমান্ত বেড়া থেকে দৌড়ে আসার সময় নিহত হয়েছেন।
গত শুক্রবার ২০ হাজার ফিলিস্তিনি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। তারা পাথর ছুড়েছেন, টায়ার পুড়িয়েছেন, স্লোগান দিয়েছেন, গান গেয়েছেন ও চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তারা বলেন, প্রাণঘাতী ইসরাইলি বাহিনী আমাদের অবরোধ করে রেখেছে। কিন্তু এতে আমরা দমে যাওয়ার বদলে বিক্ষোভে অংশ নিতে উৎসাহিত হয়েছি।
শুক্রবার বহু বিক্ষোভকারী সীমান্ত বেড়ার কাছে এসে বাফার জোনে ঢুকে পড়েছেন। ইসরাইলি বাহিনী তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করেছে।
ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক প্রধান গিওরা ইল্যান্ড বলেন, তাদের আতঙ্ক হল, কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি মুহূর্তেই বেড়া অতিক্রম করে ইসরাইলের ভেতরে ঢুকে যেতে পারেন।
ইসরাইলি বাহিনী নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্যবস্ত বানাচ্ছেন। তিনি বলেন, তারা কোনো প্রাণরক্ষা করার দায়িত্ব নিচ্ছেন না। বরং ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে সীমান্ত বেড়া রক্ষা করতে হচ্ছে।
গাজাবাসী এখন ১৫ মের চূড়ান্ত বিক্ষোভ নিয়ে কথা বলছেন। সেদিন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে সীমান্ত বেড়া পাড়ি দিয়ে ইসরাইলে প্রবেশের চেষ্টা করবেন।
ইসরাইলের জন্য ওই দিনটি দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসির গ্রুপের নাথান থ্রাল বলেন, দ্বিতীয় সপ্তাহের গাজা বিক্ষোভ নতুন গতিবেগ পেয়েছে। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের উদ্যোগে দলে দলে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীরা এটিকে প্রতিবাদ হিসেবে ভাবছেন না, তারা যেন এটিকে উদযাপন হিসেবে নিয়েছেন।
থ্রাল বলেন, বিক্ষোভকারীরা সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ছবি পুড়িয়েছেন। কিন্তু তারা আরবমিত্র ও যুক্তরাষ্ট্রকে এ বার্তাও দিচ্ছেন যে, তারা যদি ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করতে চায়, তবে তার চড়া মূল্য দিতে হবে।
গিওরা ইল্যান্ড বলেন, যদিও এমন ঘটনা এখনও ঘটেনি। যদি নারী শিশুসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গিয়ে সীমান্ত বেড়ায় হামলা করতে শুরু করেন, তখন সেটি ইসরাইলের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে।