শেষ হচ্ছে ফিদেল কাস্ত্রোযুগ, কেমন হবে কিউবা’র ভবিষ্যৎ?
চলতি সপ্তাহেই কিউবায় ঐতিহাসিক এক পরিবর্তন আসছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর কাস্ত্রো পরিবারের বাইরের কেউ বসতে চলেছেন কিউবার প্রেসিডেন্ট পদে। এরই মধ্যে দিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামাপূর্ণ কিউবার ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের শুরু হতে যাচ্ছে।
প্রায় এক দশক ধরে দেশ শাসন করে যাওয়া ৮৬ বছর বয়সী কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো এই বৃহস্পতিবারই ক্ষমতা ছাড়ছেন। ২০১৩ সালেই এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন রাউল। ধারণা করা হচ্ছে মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন রাউল। কিউবায় যখন বিপ্লব শুরু হয় তখন জন্মও হয়নি এই ক্যানেলের।
বলা হচ্ছে ৫৭ বছর বয়সী দিয়াজ-ক্যানেলকে তার বয়স ও শক্তির কারণে কমিউনিস্ট পার্টির বহু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার চেয়ে সহজেই আলাদা করে ফেলা যায়।
আসলে কিউবার বিপ্লবের পর এর আগেও কাস্ত্রো পরিবারের কেউ দেশ শাসন করেছেন। যেমন: বিপ্লবের প্রথম ছয় মাসে কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন ম্যানুয়েল উরুতিয়া। এ ছাড়া ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন অসভালদো দরতিকস।
কিন্তু নামে যিনিই শাসন করেন না করেন সবসময়েই পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন একজন কাস্ত্রো।
বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে কারণ এর মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মের কারও কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো বলছেন, তবে এ পরিবর্তন খুব ধীরে আসবে। কারণ, রাউল এখনও কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক থাকছেন।
রাউল কাস্ত্রো যখন কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আসীন হন তখন তিনি যেমন দেশ পেয়েছিলেন এখন কিউবা তার চেয়ে অনেক সংস্কারমুক্ত।
কিউবার স্থানীয়দের হোটেলে প্রবেশে ও বিদেশিদের সঙ্গে মেলামেলায় যে নিষেধাজ্ঞা ছিল ২০০৮ সালে তা বাতিল করে দেন রাউল। ২০০৮ সালে যেখানে দেশটিতে বছরে ২৩ লাখের মতো পর্যটক আসতেন, ২০১৬ সালে তা ৪০ লাখে পৌঁছে যায়।
রাউল যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার অসম্ভব ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপনে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে চুক্তির পর দৃশ্যপট বদলে গেছে। বিশ্বের অন্যতম দুর্ভেদ্য দেশটিতে এখন কাজ করে যাচ্ছে কমিউনিকেশন কোম্পানিগুলো।
এ ছাড়া কিউবার অর্থনীতি উদারিকরণে ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমানোর লক্ষে ধীরগতিতে কিছু সংস্কার প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন রাউল। ২০১০ সালে এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, হয় আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে, নয়তো ডুবতে হবে।
এই সংস্কার প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছিল বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগকে সহায়তা দেয়া, নাগরিকদের ঘরবাড়ি কেনাবেচার সুযোগ করে দেয়া, মোবাইল ফোনের মালিকানা বৈধকরণ এবং বন্দরনগরী মারিয়েলে বিশেষ একটা অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা। ফলে ২০০৫ সালে যেখানে কিউবাতে জিডিপি ৪২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। একই সময়ে ৩ হাজার ৭৭৯ মার্কিন ডলার থেকে মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলারে।
এরপরও বড় কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে দিয়াজ-ক্যানেলকে।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এখনও অনেক দূরের এক স্বপ্ন, অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি যেমনটা দেয়া হয়েছিল বাস্তবায়নের গতি তার চেয়ে ধীর এবং ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতির জোরালো ধাক্কা খেতে হয়েছে কিউবাকে। চুক্তি মোতাবেক পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় সমাজতন্ত্রী মিত্রদের সঙ্গে কিউবার বাণিজ্য ৭০ শতাংশ কমে এসেছে। ফলে দেশটিকে তেলে নিম্নমূল্য ও অথনৈতিক মন্দার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে।
কাস্ত্রো পরিবারের কেউ না হয়ে দিয়াজ-ক্যানেল কিভাবে এসব পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে।
কাউন্সিল অব দ্য আমেরিকাস কিউবা ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান অ্যালানা টিউমিনো বলছেন, নিজের গ্রহণযোগ্যতা তাকে নিজে তৈরি করে নিতে হবে। কিন্তু একেবারে নতুন কোনো এজেন্ডা বাস্তাবায়ন করার মতো কোনো নেতা তিনি না। তার কাছ থেকে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না।
তবে দিয়াজ-ক্যানেলের কিছু নীতি অনেকের কাছে বেশ ইতিবাচক। যেমন: ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের পরিসর বাড়ানো, গণস্বাস্থ্যের উন্নয়ন।
কিন্তু তার এসব নীতি কতটা তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
দিয়াজ-ক্যানেলের নিজস্ব দর্শন সম্পর্কে খুব একটা বেশি কিছু জানা যায় না, তবে তিনি ইন্টারনেট সুবিধার পক্ষে কথা বলেছেন ও আরও প্রাণবন্ত গণমাধ্যমের পক্ষে তিনি।
জাতিসংঘের ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিউবার মাত্র ৫ শতাংশ বাড়িঘরে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। আর দিয়াজ-ক্যানেলের ভাষায়, ইন্টারনেট ব্যবহার থামানোর চেষ্টা করা বৃথা।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ইন্টারনেটের ব্যবহার থামানোর চেষ্টার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি অসম্ভব।
তিনি বলেছিলেন, সমাজ এখন আরও নতুন কিছু চায়।
তবে ২০১৭ সালের আগস্টে পার্টির একটি মিটিংয়ের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে; যেখানে দিয়াজ-ক্যানেলকে রক্ষণশীল ভঙ্গিমায় কথা বলতে শোনা যায়।
দিয়াজ-ক্যানেলকে অনেকেই রহস্যময় বলে মনে করেন। ইন্টার-আমেরিকান ডায়ালগের রিকার্ডো ব্যারিওস বলছেন, এমনকি কিউবার অন্যতম ঘনিষ্ট মিত্র চীনের কূটনীতিকরাও নিশ্চিত নন দিয়াজ-ক্যানেলের মনোভাব আসলে কেমন।
ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন জড়িত- এমন আভাসও দিয়েছেন তিনি।
‘কেবল তো শুরু হচ্ছে।’