শিরোনাম
আগে চারজন দাঁড়াত, এখন একটা মারলে ৪০ জন দাঁড়াবে: ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে বন্দুক হামলায় নিহত ৩ গিনিতে ফুটবল ম্যাচে সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় ১০০ নিহত রাশিয়ার ‘হাইব্রিড আক্রমণ’ নিয়ে সতর্কতা জার্মানির ভারতে মসজিদে ‘সমীক্ষা’ চালানো ঘিরে সংঘর্ষ, নিহত ৩ সরকারের সমালোচনামূলক গান, ইরানি র‍্যাপারের মৃত্যুদণ্ড ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে যাদের জিমেইল টিকটক নিষিদ্ধ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০টির বেশি অঙ্গরাজ্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন হান কাং বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেল ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ব্রাজিলে বাস দুর্ঘটনায় ৩৮ জনের মৃত্যু নিভে গেল বাতিঘর..... গুগল-অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে দামি ব্র্যান্ড অ্যামাজন পড়াশোনা শেষে ব্রিটেনে থাকতে পারবেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা
Update : 28 April, 2018 18:56

মিয়ানমার জাতিসংঘকেও ধোঁকা দিচ্ছে!

মিয়ানমার জাতিসংঘকেও ধোঁকা দিচ্ছে!
ঢাকা অফিস :

রাখাইন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তা বাস্তবায়নে মিয়ানমার শুধু বাংলাদেশের সঙ্গেই সময়ক্ষেপণ করছে না, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেক্ষেত্রেও গড়িমসি করছে।

রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষমতাধর নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দার পর রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল দেশটি। কিন্তু নেপিডোর কিছু কার্যকলাপে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিতের নামে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করছে।

মিয়ানমার এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া নিয়ে জাতিসংঘের সমর্থন আদায়ের তোড়জোড় শুরু করেছে। দেশটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন তারা রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টার কথা নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের কাছে ব্যাখ্যা করবেন। এ থেকেই সন্দেহ হচ্ছে গত নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির মতই নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও চালাকির আশ্রয় নিতে পারে তারা।

নিরাপত্তা পরিষদের কাছে মিয়ানমার বলেছিল রোহিঙ্গাদের নিরাপাদ প্রত্যাবাসনের জন্য তারা গঠনমূলক ব্যবস্থা নিবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে রাখাইন রাজ্য এখনও রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ নয়। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা নিপীড়নে জড়িতদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

উপরন্তু রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। সংঘাত থেমে যাওয়ার পরও রোহিঙ্গা নিপীড়নের যেসব চিহ্ন হয়ে পুড়ে যাওয়া যেসব ঘরবাড়ি ছিল সেগুলোও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে তারা দেশে ফিরলেও নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারবে না। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে আশ্রয় শিবিরে। সেখানে তারা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা বাহিনীর পাহারায় থাকবেন, যে বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

এর পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সদিচ্ছা দেখাতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের এসব আশ্রয় শিবির পরিদর্শনে নিয়ে যেতে পারে মিয়ানমার।

আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে গত বছর সেপ্টেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমার বলেছিল তারা যে কোনো সময় রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ১৫ সদস্যের পরিষদের কাছে এই কথা বলেছিলেন। জাতিসংঘের নথি থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৯৯২ সালে যে কাঠামোগত চুক্তি হয়েছিল সে অনুযায়ী এই প্রত্যাবাসন হবে বলেও সেদিন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার পুরো প্রক্রিয়াকে জটিল করে দেওয়ায় সাত মাস পরও রোহিঙ্গারা নিজভূমে ফিরতে পারেনি।

নিরাপত্তা পরিষদের ওই বৈঠকের পরের মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে মিয়ানমার। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দুই দেশেরই পূর্ণ সহযোগিতার কথা বলা হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও কথা বলে মিয়ানমার। কিন্তু এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে আরও প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে।

বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা ও পুনর্বাসনে তথাকথিত “ইউনিয়ন ইন্টারপ্রাইজ মেকানিজম”-এর কথা প্রচার করেছিল মিয়ানমার। কিন্তু এর সবই যে আন্তর্জাতিক সমালোচনা বন্ধ করতে ও নিরাপত্তা পরিষদকে নিজেদের পক্ষে টানতে করা হয়েছিল সেটি এখন তাদের গড়িমসি থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে এটি যে তখন কাজে দিয়েছিল সেটি গত বছর ৬ নভেম্বরের প্রেসিডেন্টশিয়াল বিবৃতি থেকে বোঝা যায়। ওই বিবৃতিতে মিয়ানমারের এসব পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদ। তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছিল তখন।

কিন্তু এর পরও মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে কোনো রকম সদিচ্ছা দেখায়নি। গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি হয় তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের (ভেরিফিকেশন)প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে মিয়ানমার। এতে এমন কিছু শর্ত যোগ করা হয় যাতে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯২ সালের চুক্তিতে এ ধরনের শর্তের কথা বলা ছিল না।

কিন্তু এই চুক্তির পরও রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাতে থাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তারা অভিযোগ তোলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরিতে কার্যকর কিছুই করেনি মিয়ানমার সরকার। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে তারা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেসব খাতা কলমেই থেকে গিয়েছিল। বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই করেনি। এর পর ১২ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে ফের জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর তীব্র নিন্দার মুখে পড়ে মিয়ানমার।

এই সমালোচনা বন্ধ করতে ও নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন আদায়ে এবার তারা বাংলাদেশের সঙ্গে করা ২৩ নভেম্বরের চুক্তিটিকে সামনে নিয়ে আসে। মিয়ানমারের প্রতিনিধি হাউ দো সুয়ান নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেছে। নিরাপত্তা পরিষদকে তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখ থেকে দুই মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।

ওই চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে মিয়ানমার এমন একটি শর্ত দেয় যাতে পুরো প্রক্রিয়াটিই থমকে যায়। এর পর ১৬ জানুয়ারি পরিবার ধরে রোহিঙ্গাদের তালিকা চায় মিয়ানমার যাতে সায় দেয় ঢাকা।

গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা তৈরির কাজ করছিল বাংলাদেশের পাসপোর্ট অধিদপ্তর। কিন্তু এসময় রোহিঙ্গাদের পরিবার হিসাব করে তালিকা করা হয়নি। এর পর ১৬ জানুয়ারির বৈঠকের পর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সংগ্রহ করা তথ্য ও ছবি সেই সঙ্গে বায়োমেট্রিক তথ্য ব্যবহার করে পরিবার ধরে ফের রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করতে হয় । কিন্তু এভাবে তালিকা তৈরি কাজ শেষ করতে আরও সময়ের প্রয়োজন।

এর মধ্যেই নতুন একটি কৌশলের আশ্রয় নেয় মিয়ানমার সরকার। ২৩ জানুয়ারি মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী কিউ তিন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দোষারোপ করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরাতে প্রস্তুত থাকলেও বাংলাদেশ সময়ক্ষেপণ করছে।

এর পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের বিরোধিতার কারণেও মিয়ানমারের ওপর কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী এই দুই সদস্য তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে মিয়ানমারের সকল অপকর্মকে জায়েজ করে চলেছে। ২০০৭ সাল থেকে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা এটা করছে।

চীন ও রাশিয়ার সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে এখন পর্যন্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে মিয়ানমার। একই ভাবে তারা গত সাত মাস থেকে নিরাপত্তা পরিষদকে ধোঁকা দিয়ে চলেছে। 

সূত্র: দ্যা ডেইলি স্টার

উপরে