সুইস ব্যাংক থেকে দ্রুত টাকা তুলে নিচ্ছে বাংলাদেশিরা
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের অর্থ প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৬৭ শতাংশ কমে গেছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ সাড়ে ৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ থেকে কমে ১ কোটি ৮০ লাখ ফ্রাঁ হয়েছে। দেশটির ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ তুলে নেওয়ার এই গতিকে তীব্র বলা হচ্ছে।
যদিও সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ তুলে নেওয়ার হার গত এক দশক ধরে বাড়ছিল।
তবে, প্রায় এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশির আমানত বৃদ্ধির পর হুট করে তা কমছে কেন, এর ব্যাখ্যা নেই ওই প্রতিবেদনে।
এর আগে, এসএনবির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালেও সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে তা কমে ৫ কোটি ৫০ লাখ ফ্রাঁতে দাঁড়ায়। আর বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসএনবি বলেছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৫ কোটি ৫০ লাখ ফ্রাঁ থেকে কমে ১ কোটি ৮০ লাখ ফ্রাঁ হয়েছে। বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৩১ টাকা। সেই হিসাবে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৩৮ কোটি টাকা।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে অর্থ জমা হয়, তা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে জমা হয়। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া এসব অর্থ সে দেশের দায় হিসাবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ একলাফে এক বছরে ৬৭ শতাংশ কমে যাওয়ায় তথ্যটি এমন একসময়ে এসেছে, যখন দেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
জানা গেছে, গোপনে অর্থ গচ্ছিত রাখার জন্য বহুদিনের খ্যাতি সুইজারল্যান্ডের। কঠোরভাবে গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখে সুইস ব্যাংকগুলো। যে কারণে প্রচলিত বিশ্বাস, অবৈধ আয় আর কর ফাঁকি দিয়ে জমানো টাকা জমা রাখা হয় সুইস ব্যাংকে। নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও এক দশক ধরে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক। তাতেই ওঠে আসছে এসব তথ্য। ধারণা করা হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে গোপনীয়তা কমতে থাকায় বাংলাদেশিসহ অনেক দেশের ধনীরাই এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য কানাডা, দুবাই, লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা বারমুডার মতো ট্যাক্স হ্যাভেন দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছেন।
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ার পেছনে গোপনীয়তার অভাবকে দায়ী করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তারা বলছেন, এখনো প্রতি বছর দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। তবে আগে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিরা পাচারের অর্থ জমা করলেও এখন আর করছে না। কারণ সেখানে কোনো গোপনীয়তা নেই। সরকার চাইলে বা সুইস ব্যাংক নিজে থেকেও সেসব তথ্য প্রকাশ করে থাকে। সেজন্য সুইস ব্যাংকের আমানত তুলে কানাডা, দুবাই বা অন্যকোনো দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন তারা। এ ছাড়া দেশের চলমান ডলার–সংকটও অন্যতম কারণ। তারা বলছেন, দেশে ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় দেশটিতে অর্থ জমার বা বিনিয়োগের সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশ থেকে এখনো প্রতি বছর অর্থ পাচার বাড়ছে। যা দেশের অন্যতম সমস্যা। তবে পাচারের এই অর্থ আগে সুইস ব্যাংকে গোপনে রাখার সুযোগ পেলেও এখন আর সেই সুযোগ পাচ্ছে না পাচারকারীরা। কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে সুইস ব্যাংকের কাছে রাখা অর্থের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা সেটা প্রকাশ করে। আবার সুইস ব্যাংক নিজেও সেই তথ্য প্রকাশ করে থাকে। তাই পাচারকারীরা গোপনীয়তা রক্ষা করে এমন কোন জায়গায় যেমন কানাডা বা দুবাই বা অন্য কোনো দেশে তাদের অর্থ সরিয়ে নিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অর্থ জমা রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের বাণিজ্যিক অনেক ব্যাংকও দেশটিতে অর্থ রাখে। দেশে ডলার-সংকট দেখা দেওয়ায় হয়তো এসব প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে বা নতুন করে অর্থ জমা রাখতে পারেনি।
এ ছাড়া সুইজারল্যান্ডে এখন অনেক বাংলাদেশি থাকেন। তারাও বৈধভাবে সেখানকার ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। যেহেতু বিশ্বজুড়ে এক ধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে, তাই হয়তো বৈধভাবে যারা সেখানে অর্থ জমা রাখতেন, তাদের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে গেছে। তাই সার্বিকভাবে হয়তো বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমেছে দেশটিতে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ৮৭২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁতে পৌঁছায়। যা দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমা। তবে ২০২০ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ তার আগের বছরের তুলনায় কম ছিল। ওই বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকার বেশি। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁ। ২০১৮ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। আর ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ।
এদিকে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে শুধু যে বাংলাদেশিদের অর্থ কমেছে, তা নয়। ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ জমার পরিমাণও কমেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকের সুইস ব্যাংকে অর্থ আমানতের হার ২০২৩ সালে প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে। গত চার বছরের মধ্যে ভারতীয়দের আমানতের পরিমাণ সর্বনিম্নে পৌঁছেছে ২০২৩ সালে। আমানত হ্রাস পাওয়ার পরও সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের অর্থের পরিমাণ ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়িয়েছে; যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯ হাজার ৭৭১ কোটি রুপি। এ নিয়ে সুইস ব্যাংকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের আমানত টানা দ্বিতীয়বারের মতো কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যেসব অর্থ জমা রয়েছে, সেগুলো যে সব পাচারের অর্থ, তা বলা যাবে না। কারণ, সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারীরাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বৈধভাবেও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। ব্যক্তির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অর্থ জমা রাখা হয় দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে।